সোহাগ দেওয়ান//
দেশের তৃনমুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার মানউন্নয়নে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের অধীন ক্রীড়া পরিদপ্তর গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে থাকে। প্রাইমারী পর্যায় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করে বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিদপ্তর। সম্প্রতি ক্রীড়া পরিদপ্তরের জনবল নিয়োগে জাল জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২৫জন কর্মচারী নিয়োগে ১০জনেরই পরিচয় জালিয়াতি তথ্য মিলেছে। ইতোমধ্যে ক্রীড়া পরিদপ্তরের নিয়োগ, নির্বাচন কমিশনের তথ্য, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সনদের এ জাল জালিয়াতির সত্যতা পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে এসকল অনিয়মের কারিগর হিসেবে ক্রীড়া পরিদপ্তরের অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পরিচালক ও উপ পরিচালকের একান্ত সহকারি মোঃ বখতিয়ার খলজি’র নাম উঠে এসেছে। নিজের আপন ভাইসহ এলাকার বেশ কয়েকজনের কাগজপত্র জাল জালিয়াতির নির্দেশদাতা তিনি। এরপর ১০ থেকে ১৫লাখ করে মোটা অংকের ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগ পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। তার স্ত্রীও পরিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে চাকুরী করেন। নিয়োগ বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তাদের সাথে বখতিয়ার খলজি’র মুঠোফোন আলাপে তার এ দুর্নীতির তথ্য মিলেছে। এছাড়াও ক্রীড়া পরিদপ্তরের বিভিন্ন্ ইভেন্টের বরাদ্ধের টাকা আত্মসাতেরও বেশ কিছু প্রমান পাওয়া গেছে। তার এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাব হলেও পরিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা ঝামেলায় না জড়িয়ে এসকল অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা এড়িয়ে চলেন।
ক্রীড়া পরিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী পরিচালক মোঃ আলী রেজা এবং উপ পরিচালক মোঃ নুরুল ইসলামও এই নিয়োগের জালিয়াতির বিষয়ে অবগত বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছেন। উপ পরিচালক মোঃ নুরুল ইসলাম এই নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন।
তবে চাকুরী স্থায়ীকরনের পুর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত পুলিশী তদন্ত প্রতিবেদনে এ ধরনের জাল জালিয়াতির প্রমান মিললে নিয়োগপ্রাপ্তরা চাকুরী হারাবেন। এবং পাশাপশি ফৌজদারি আইনে পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে মামলাও দায়ের করা হবে বলে পরিদপ্তরের বর্তমান পরিচালক মোহাম্মাদ নূরে আলম সিদ্দিকী জানিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, অভিযোগ ওঠা এই নিয়োগপ্রাপ্তদের পুলিশ ভেরিফিকেশন এখনও করা হয়নি। দ্রুত এ পুলিশী তদন্তের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ক্রীড়া পরিদপ্তরের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর পদে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ৯টি ক্যাটাগরীর ২৫টি শুণ্য পদে লিখিত পরিক্ষা শেষে ২০২১ সালের ১৪জুন উত্তীর্ণ হওয়া ৯শ’ ৪৯জন পরিক্ষার্থীর রোল নম্বর প্রকাশ করা হয়। ১০অক্টোবর চুড়ান্তভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া ২৫জনের রোল নম্বর প্রকাশ হয়। ১৭ অক্টোবর ওই ২৫জনের নাম ঠিকানা পরিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে তারা সকলেই ক্রীড়া পরিদপ্তরে কর্মরত রয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্ত ২৫জনের কাগজপত্র যাচাই কওে দেখা গেছে তাদের মধ্যে ১০জনের কাগজে জাল জালিয়াতি করা হয়েছে। কোঠা নেই কিন্তু সেই সকল জেলার প্রার্থীদের মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে চাকুরীতে নিয়োগের দিয়েছে পরিদপ্তর। ওই সকল প্রার্থীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের জেলার ঠিকানা জালিয়াতির চিত্র বেড়িয়ে এসেছে।
কাগজপত্র জাল জালিয়াতি করে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ক্রীড়া পরিদপ্তরের এই নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করেছেন ক্রীড়া পরিদপ্তরের পরিচালক ও উপ পরিচালকের একান্ত সহকারি মোঃ বখতিয়ার খলজি। ৩য় শ্রেণীর একজন কর্মচারী হয়ে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার এসকল অনিয়ম নিয়ে কথা বললে বিভিন্ন জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তাদের ধমকের সুরে কথা বলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মোঃ বখতিয়ার খলজি’র বক্তব্য চাইলে তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলতে রাজি হননি।
নিয়োগে কাগজ জালিয়াতির ওই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে রংপুর জেলার কোন কোঠা না থাকা সত্ত্বেও ভূয়া কাগজপত্র দাখিল করে ১০জনকে নিয়োগ পাইয়ে দেয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে রংপুর জেলা সদরের ৭নং ওয়ার্ডের ময়না কুটি এলাকার মোঃ মাহবুবুর রহমানের ছেলে মোঃ মনিরুজ্জামানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার নিয়োগের ঠিকানায় রংপুরের কোঠা না থাকায় বগুড়া জেলা সদরের ১৩ নং ওয়ার্ডের সুজাবাদ এলাকার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে রংপুর জেলার মোঃ আব্দুল হাই’র ছেলে মোঃ মনজুরুল হাসানকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার খাষলেদারপুরের ঠিকানা। হিসাব রক্ষক পদে রংপুর জেলা সদরের বুড়িরহাট ফার্ম এলাকার মোঃ আব্দুল মোন্নাফের ছেলে মোঃ আব্দুল আজিজকে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার কাটবওলা বাজার এলাকার ঠিকানায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অফিস সহায়ক পদে রংপুর জেলা সদরের ময়না কুটি এলাকার মোঃ নওফেল মিয়ার ছেলে মোঃ লিটন মিয়াকে গাইবান্ধা জেলার গাইবান্ধা পৌরসভার দক্ষিণ ধানঘড়’র ঠিকানা ব্যবহার করে চাকুরী দেয়া হয়েছে। অফিস সহায়ক পদে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর ১নং ওয়ার্ড জলির পাড়ের সুশিল মন্ডলের পুত্র সম্রাট মন্ডলকে দেয়া নিয়োগে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার সোনাবাজু, জয়কৃষ্ণপুরের ঠিকানা ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রাউন্সম্যান পদে রংপুর জেলা সদরের ময়না কুটি এলাকার মোঃ আকবর আলীর ছেলে মোঃ আবু বকর সিদ্দিকের নিয়োগে ব্যবহার করা হয়েছে পাবনা জেলা সদরের দোগাছি বোরকাখালীর ঠিকানা। গ্রাউন্সম্যান পদে রংপুর জেলার গংগাচড়ার গজঘন্টা এলাকার মৃত শফিকুল ইসলামের ছেলে মোঃ রজবুল ইসলামকে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলর কিটক গ্রামের নাম ব্যবহার করে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। মালি পদে মুন্না ভিলা রংপুর জেলার গংগাচড়ার গজঘন্টা কিসমত হাবু এলাকার মোঃ আলতাফ হোসেন’র ছেলে মোঃ এম, এই মুন্নাকে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার জোড়গাছ এলাকার ঠিকানায় চাকুরী দেয়া হয়েছে। অফিস সহায়ক পদে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার নেংগুড়হাট, বাজ চালুয়াহাটি গ্রামের মোঃ আহাদ আলীর ছেলে মোঃ আল মামুনকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ওই জেলায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোন কোঠা নেই। অফিস সহায়ক পদে শরিয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার উত্তর হলইপট্টি এলাকার ওমর আলীর ছেলে সাইফুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার কাগজে ত্র“টি ধরা পড়ায় এখনও পর্যন্ত তার সরকারি বিতন বিল দাখিল হয়নি।
এবিষয়ে নিয়োগে কাগজ জালিয়াতি হওয়া প্রার্থীদের সাথে কথা বললে তারা কর্তৃপক্ষের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন, সব কিছু যাচাই-বাছাই করেই আমাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে।